ভুট্টার সার প্রয়োগের তালিকা। ভুট্টার সার প্রয়োগ ব্যাবস্থাপনা। ভুট্টার জমিতে কি কি সার দিতে হয়

ভুট্টা (Zea mays) হচ্ছে একটি জনপ্রিয় খাদ্যশস্য, যা আমেরিকা মহাদেশে উদ্ভূত হয়েছিল এবং পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এটি শুধু মানুষের খাদ্য হিসেবেই নয়, হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য, এমনকি গোখাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ভুট্টা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ ও আঁশের উৎস।

ভুট্টার সার প্রয়োগের তালিকা। ভুট্টার সার প্রয়োগ ব্যাবস্থাপনা। ভুট্টার জমিতে কি কি সার দিতে হয়

প্রকারভেদ

ভুট্টার বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, যা তাদের বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। সবচেয়ে সাধারণ কিছু প্রকার হলো: 

ডেন্ট কর্ন: এর দানার উপরে ছোট দাঁতের মতো আকৃতি থাকে। এটি প্রধানত পশুখাদ্য এবং শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।

ফ্লিন্ট কর্ন (চকমকি): এর দানা শক্ত এবং মসৃণ হয়। এটি পপকর্ন এবং কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

পপকর্ন: এটি এক ধরনের ফ্লিন্ট কর্ন, যা উচ্চ তাপমাত্রায় ফাটিয়ে পপকর্ন তৈরি করা হয়।

সুইট কর্ন (মিষ্টি ভুট্টা): স্বাদে মিষ্টি হওয়ার কারণে এটি সাধারণত সিদ্ধ বা ভেজে খাওয়া হয়। 'অ্যামব্রোসিয়া' এবং 'গোল্ডেন ব্যান্টাম' হলো মিষ্টি ভুট্টার জনপ্রিয় জাত।

ফ্লাওয়ার কর্ন (ময়দা ভুট্টা): নরম প্রকৃতির হওয়ায় এটি ময়দা তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়।

ওয়াক্সি কর্ন (মোম ভুট্টা): এর দানায় উচ্চ মাত্রার মোম থাকে, যা শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়। 

পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা 

ভুট্টা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, একটি মাঝারি আকারের (১০০ গ্রাম) ভুট্টায় প্রায় ৮৭.৭ ক্যালরি, ৩.৩ গ্রাম প্রোটিন এবং ১৯.১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে। এর কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা হলো: 

হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে: এতে থাকা ফাইবার হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।

দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে: ভিটামিন এ, বিটা-ক্যারোটিন এবং লুটিন উপাদান থাকার কারণে এটি চোখের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।

হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়: ভুট্টা হৃদরোগ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে: ভুট্টার ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

শক্তি জোগায়: এতে থাকা শর্করা দেহে পর্যাপ্ত শক্তি সরবরাহ করে।

রক্তস্বল্পতা দূর করে: প্রচুর আয়রন থাকায় এটি রক্তস্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে। 

চাষের পদ্ধতি

ভুট্টা চাষের জন্য কিছু সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করতে হয়: 

মৌসুম: বাংলাদেশে সাধারণত রবি (নভেম্বর-ডিসেম্বর), গ্রীষ্ম (মার্চ-এপ্রিল) এবং বর্ষা (জুলাই-আগস্ট) এই তিন মৌসুমে ভুট্টা চাষ করা হয়।

মাটি: ভালো জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ উর্বর দোআঁশ বা পলি মাটিতে ভুট্টা ভালো জন্মে। বেলে বা ভারী এঁটেল মাটি ভুট্টা চাষের জন্য তেমন উপযুক্ত নয়।

জমি তৈরি: ভালো ফলনের জন্য মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হয়।

সার প্রয়োগ: জমি তৈরির সময় গোবর সার, জিংক সালফেট এবং অন্যান্য রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয়।

ফসল সংগ্রহ: যখন মোচার খড়ের মতো রং হয়ে যায় এবং বীজের গোড়ায় কালো দাগ দেখা যায়, তখন ভুট্টা সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। 

ভুট্টা একটি সার-প্রিয় ফসল এবং ভালো ফলনের জন্য জমিতে পর্যাপ্ত ও সুষম সার প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি। মাটির উর্বরতাভেদে সারের মাত্রার কিছুটা তারতম্য হতে পারে, তাই মাটি পরীক্ষা করে সার প্রয়োগ করলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। 


নিচে ভুট্টা জমিতে সারের পরিমাণ (বিঘা প্রতি) এবং প্রয়োগের নিয়ম দেওয়া হলো:
সারের পরিমাণ (বিঘা প্রতি ৩৩ শতকে আনুমানিক) 

সারের নাম  পরিমাণ (কেজি/বিঘা) প্রয়োগের সময় ও পদ্ধতি
ইউরিয়া ৬৬-৭০ কেজি তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে
 (নিচে দেখুন)।
টিএসপি ৪০-৪৬ কেজি জমি তৈরির শেষ চাষের সময়
মাটির সাথে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে।
এমওপি ৩৩-৪৩ কেজি টিএসপি-র সাথে একই
সময়ে প্রয়োগ করতে হবে।
জিপসাম ২০-২৪ কেজি টিএসপি-র সাথে একই
 সময়ে প্রয়োগ করতে হবে।
জিংক সালফেট ১-১.৫ কেজি টিএসপি-র সাথে একই
সময়ে প্রয়োগ করতে হবে।
বোরিক অ্যাসিড/বোরন সার ৪০০-৫০০ গ্রাম টিএসপি-র সাথে একই
সময়ে প্রয়োগ করতে হবে।
গোবর সার ১৫০-২০০ কেজি জমি তৈরির প্রথম চাষের
সময় প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।

(১ বিঘা = ৩৩ শতক)

সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ ইউরিয়া সার ছাড়া বাকি সব সার (টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক সালফেট, বোরিক অ্যাসিড এবং গোবর) জমি তৈরির শেষ চাষের সময় মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।বাকি ইউরিয়া সার সমান দুই কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

প্রথম কিস্তি: বীজ বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে (গাছের ৪-৬ পাতা পর্যায়)।

দ্বিতীয় কিস্তি: প্রথম কিস্তির ২০-২৫ দিন পর বা যখন গাছ হাঁটুর সমান উঁচু হয় (সাধারণত ফুল আসার ঠিক আগে)।

গুরুত্বপূর্ণ কিছু টিপস:

আর্দ্র মাটি: মাটি আর্দ্র বা ভেজা থাকলে সার প্রয়োগ করুন। শুকনো মাটিতে সার প্রয়োগ করলে গাছের ক্ষতি হতে পারে।

সঠিক প্রয়োগ: সার গাছের গোড়া থেকে অন্তত ৫ সেন্টিমিটার দূরে ছিটিয়ে বা রিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে সরাসরি গাছের সংস্পর্শে না আসে।

আগাছা নিয়ন্ত্রণ: সার প্রয়োগের আগে জমি আগাছামুক্ত রাখুন, অন্যথায় আগাছা সারের পুষ্টি গ্রহণ করবে।

মাটি পরীক্ষা: সর্বোত্তম ফলাফলের জন্য স্থানীয় কৃষি অফিসারের পরামর্শ অনুযায়ী মাটি পরীক্ষা করে সারের সঠিক মাত্রা নির্ধারণ করুন।

  • ভুট্টার দাম ২০২৫
২০২৫ সালে ভুট্টার দাম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারের কারণের উপর নির্ভর করে ওঠানামা করেছে। সাধারণত
 বছরের শুরু থেকে চাহিদা বেশি থাকায় দাম বেশি ছিল, কিন্তু বছরের শেষের দিকে সরবরাহ বাড়লে দাম কমতে পারে। 

বাজারের বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশের বাজারে: এপ্রিল ২০২৫-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ভুট্টার চাহিদা 
ক্রমাগত বেশি থাকায় পাইকারি ও খুচরা উভয় বাজারেই ভুট্টার দাম বেশি ছিল।
দাম: ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ পাইকারি মূল্য ছিল প্রতি কেজি প্রায় ৩৪.৪৯ টাকা এবং খুচরা মূল্য ছিল প্রায় ৩৮.৪৭ টাকা।

চাহিদার কারণ: পোলট্রি, দুগ্ধ এবং অ্যাকুয়াকালচার শিল্প থেকে সারা বছর ধরে শক্তিশালী চাহিদা 
এর অন্যতম প্রধান কারণ।
বৈশ্বিক বাজারে: ২০২৫ সালের শুরুতে বিশ্বব্যাপী ভুট্টার দাম দুই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বেড়ে রেকর্ড উচ্চতায় 
পৌঁছেছিল। এর কিছু কারণ হলো:
উৎপাদন কম ও মজুদের পরিমাণ কম থাকা।
বায়োফুয়েল উৎপাদনে ভুট্টার ব্যবহার বৃদ্ধি। 

বাজারের পূর্বাভাষ

দাম কমতে পারে: প্রধান ফসল তোলার মৌসুম এগিয়ে আসায় সরবরাহ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। 
ফলে দাম কিছুটা কমতে পারে।
ভুট্টা স্টার্চের বাজারের বৃদ্ধি: বাজার পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বিশ্বব্যাপী ভুট্টা স্টার্চের বাজার 
আরও বাড়বে। এর কারণ হলো খাদ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং বস্ত্র শিল্পের মতো বিভিন্ন খাতে এর 
ব্যবহার বৃদ্ধি।
স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি: দ্যা ডেইলি স্টার (বাংলা)-এর ২০ মে, ২০২৫-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, 
বাংলাদেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে এবং আমদানি নির্ভরতা কমেছে। এটি স্থানীয় বাজারে স্থিতিশীলতা
 আনতে সাহায্য করতে পারে। 

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

আন্তর্জাতিক বাজারে ওঠানামা: বিশ্ববাজারে পণ্যের দামের পরিবর্তন, রপ্তানি বা আমদানির সীমাবদ্ধতা 
এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতিবিধির মতো বিষয়গুলো ভুট্টার মূল্যে প্রভাব ফেলতে পারে।
আবহাওয়ার প্রভাব: বৈরী আবহাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হলে দাম বাড়তে পারে।
পণ্যের ধরন ও অঞ্চল: ভুট্টার দাম বিভিন্ন অঞ্চলে এবং পণ্যের ধরনের (যেমন বীজ বা গুঁড়ো) উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url